Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
ভাঙছে নদীর কূল, শিক্ষার্থীরা হারাচ্ছে স্কুল
বিস্তারিত

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও বেলাল হোসেন জুয়েল, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ভাঙছে নদীর কূল, শিক্ষার্থীরা হারাচ্ছে স্কুল
ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কমলনগর, লক্ষীপুর: স্কুলের পাকা ভবন নদীতে হারিয়ে যাওয়ার পর চর জগবন্ধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়া হয় একটি বাড়িতে। সেখানে বেশি দিন রাখা সম্ভব হয়নি বলে ওই আসবাবপত্র আবার স্থানান্তর করা হয় একটি মসজিদে।

অবশেষে রাস্তার পাশে টিনের চালা দিয়ে বেঞ্চ পেতে চলছে ক্লাস। অন্যদিকে চর জগবন্ধু মুন্সিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস চলছে এলাকার একটি মাদ্রাসার কক্ষে। সেখানে সবার ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
লক্ষীপুরের কমলনগর উপজেলায় শিক্ষাচিত্রটা অনেকটা এমনই। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হচ্ছে। মেঘনা গিলে খাচ্ছে যুগে যুগে গড়ে ওঠা এক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাড়িঘর হারানো পরিবারের ছেলেমেয়েরা অন্যত্র চলে যাওয়ায় বিদ্যালয়গুলোতে কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ফলে নতুন করে বিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ভাঙন কবলিত স্কুল-মাদ্রাসার প্রধানেরা।  
school
কমলনগর উপজেলা সদর হাজীরহাট থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে সাহেবের হাট ইউনিয়নের মাতব্বর নগর। সড়কটির শেষ মাথা মিলেছে মেঘনায়। স্থল পথে সামনে এগোনের আর কোনো পথ নেই। স্থানীয়রা জানালেন, এ পিচঢালা সড়কটি কমলনগর-লক্ষীপুরের বিকল্প সড়ক। এ সড়ক দিয়ে এলাকার মানুষ সহজেই লক্ষীপুর যাতায়াত করতে পারতো। রাস্তাটি ভেঙ্গে যাওয়ায় এখন যেতে হয় অনেক দূর ঘুরে।

মাতব্বর নগরের পিচঢালা সড়কের দুপাশে চোখে পড়ে অসংখ্য বিপন্ন বাড়ি। হয়তো ভাঙনের কিনার থেকে বাড়িটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে গাছপালা। তাও যতটা সম্ভব কেটে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন এলাকার মানুষ। ঘরের চালা, খুঁটি ভাঙনের তীর থেকে সরিয়ে নিতে নিতে সেলিম মিয়া বলেন, সবই তো শেষ হইয়া গেল।

আর কোথায় যাবো। যাওয়ার জায়গা নেই বলে হাজীরহাটে একটি ভাড়া বাসায় উঠছি।

স্থানীয় সূত্র বলছে, এলাকার বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মেঘনায় ডুবে যাওয়া পশ্চিম চর লরেন্স সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কাদির পন্ডিতের হাটের কাছে আমিন বাড়ির দরজায় সরানো হয়েছে। খানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মাতব্বর হাটের পাশে নেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণ চর কালকিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি মধ্য চর মার্টিনে নেওয়া হয়েছে। চর জগবন্ধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কাশেম মাতব্বরের বাড়ির সামনে নেওয়া হয়েছে। মুন্সিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে একটি মাদ্রাসার কক্ষে। কাদির পন্ডিতের হাট উচ্চ বিদ্যালয়টি বর্তমানে চর লরেন্সে। শফিকগঞ্জ মহিলা মাদ্রাসার কার্যক্রম চলে করুনা নগরে। মাতব্বর নগর দারুচ্ছুন্নাহ আলীম মাদ্রাসাটি নেওয়া হয়েছে ফজু মিয়ার হাটে।
school-22
বাংলানিউজের দেখা সরেজমিন মাঠচিত্র বলছে, কমলনগরের এ এলাকায় মেঘনা ভাঙছে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। হারিয়ে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। হুমকিতে আছে মধ্য চর জগবন্ধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর জগবন্ধু হাইস্কুল, ডাক্তারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক আর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়।

একইসঙ্গে বাড়িঘর আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেঙে যাওয়ায় বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষকেরা একদিকে বিদ্যালয় সরানো আর অন্যদিকে বাড়িঘর সরিয়ে নেওয়া শিক্ষার্থীদের খুঁজে বেড়ান।

চর জগবন্ধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, এ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দুমাসের ব্যবধানে বিলীন হয়ে গেছে। এটিকে আগের স্থান থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে আনা হয়েছে। এখানেও নিরাপদ নয়। কোনোমতে একটি টিনের চালা দিয়ে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে অন্তহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া না হলে ডিসেম্বরের মধ্যে এ স্থানটিও বিলীন হয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে নদীভাঙনে বসতি হারিয়ে যাওয়া। নদীভাঙনে সব হারিয়ে বহু পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। তারা আর বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না। ভাঙনের আগে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪৬ জন থাকলেও ভাঙনের পর এ সংখ্যা ১৮০ জনে নেমে এসেছে।
school-school-
চর জগবন্ধু মুন্সিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোসলেহ উদ্দিন আলমগীর বলেন, বিদ্যালয়টি মোট দুবার স্থানান্তর করা হয়েছে। এখন বিদ্যালয়ের ক্লাস চলছে দারুল উলুম নূরানী মাদ্রাসার একটি কক্ষে।

ভাঙনের আগে এ বিদ্যালয়ে ২৯৭ জন শিক্ষার্থী থাকলেও এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ২১৫ জন।

ভাঙন কবলিত এলাকার অভিভাবকেরা বাংলানিউজকে সরেজমিনে পেয়ে বলেন, বাড়িঘর পরিবর্তনের কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আগে স্কুলমুখী অনেক ছেলেমেয়ে এখন সব হারিয়ে নি:স্ব পরিবারগুলোতে সহায়তা করছে। ছেলেদের অনেকে মাছ ধরতে নেমেছে নদীতে। তবে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেনি কমলনগর উপজেলা শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা।

কমলনগরের সহকারী শিক্ষা অফিসার রওশন ফেরদৌস বাংলানিউজকে বলেন, বছর শেষে এ ধরনের কোনো হিসাব করে দেখা হয়নি। তবে বছরের শুরুতে এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এ এলাকাটি প্রাকৃতিকভাবেই বিপন্ন। জোয়ারের পানিতে ডুবে অনেক স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। এ জন্য এ এলাকায় জোয়ারের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাদানের পৃথক সময়সূচি নির্ধারণ করা যেতে পারে।

সূত্র বলছে, কমলনগর উপজেলার ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোর মধ্যে চর ফলকন, সাহেবের হাট, কালকিনি, পাটোয়ারী হাট ও লরেন্স ইউনিয়ন উল্লেখযোগ্য। উপজেলায় দু লাখ ২২ হাজার ২৫১ জন লোকের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার ভাঙন বাস্তুভিটা হারা। ইউনিয়নের ১১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়েছে। যা উপজেলা মোট আয়তনের এক চতুর্থাংশ। অন্তত ৩০০ কোটি টাকার সরকারি বেসরকারি স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আরও পাঁচ হাজার কোটি টাকার স্থাপনা হুমকির এখন মুখে।
school-42013


স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ভাঙনরোধে সরকারের বিশেষ কোনো প্রকল্প এ এলাকায় বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এলাকার মানুষের উদ্যোগে ২০১২ সালে ১০০ মিটার জিও (বালির বস্তা) বাঁধ দেওয়া হয় কমলনগরের চর ফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া এলাকায়।

জিও ব্যাগে বালু ভর্তি করে মেশিনে সেলাই করে এগুলো তৈরি করা হয়। টাকা প্রয়োজন ছিল এক কোটি। এর মধ্যে ৭০ লাখ স্থানীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ বাঁধ থাকাকালে নয় মাসে ৫০ মিটার ভেঙেছে। আর বাঁধ বিলীন হয়ে যাওয়ার পর মাত্র একমাসে ৩০০ মিটার ভেঙেছে।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাসহ সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় এ জিও বাঁধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। সহযোগিতা বিপরীতে অনেক রাজনৈতিক নেতা অসহযোগিতা করেছেন। এ বাঁধের মুখোমুখি বিরোধিতা করেছেন। অথচ এ বাঁধ স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করে কিনারে পলি ফেলতে সহায়ক হতো। ভাঙন রোধ হতো।

উপজেলা নদীভাঙন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব ও চর ফলকন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ এন এম আশরাফ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ভাঙনরোধে স্থানীয়ভাবে নেওয়া উদ্যোগের ওপর স্টাডি করে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিলে কমলনগরের ভাঙন রোধ হবে। ড্রেজিং করে মেঘনার গতিপথ ঠিক রাখতে হবে। ডুবোচর অপসারণ করতে হবে। তাহলেই কমলনগর মেঘনার গ্রাস থেকে রক্ষা পাবে।

কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল বাংলানিউজকে বলেন, ভাঙনের ফলে এ এলাকার মানুষের জীবন বিপন্ন। ভাঙনের কারণে এলাকার মানুষকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্ভোগে পড়তে হয়। প্রশাসনের তরফ থেকে বিপন্ন মানুষদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়।

  সংগ্রহ -এ এন এম আশরাফ উদ্দিন

চেয়ারম্যান,৫নং চর ফলকন ইউপি

ছবি
ডাউনলোড