![]() |
ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম |
রামদাসপুর দ্বীপ, ভোলা: ৩০০ বছরের (প্রায়) পুরনো ঐতিহ্যবাহী রামদাসপুর দ্বীপটি আর থাকছে না। ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ, একশ বছরের পুরোনো বটগাছ, দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাগদা চিংড়িপল্লী সব গিলেছে ভয়াল মেঘনা।
হারিয়ে গেছে অন্তত সাত হাজার বসতবাড়ি, ব্রিটিশ আমলের পুরোনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, তিন শতাধিক একর ফসলি জমি, গাছপালা, সান বাঁধানো পুকুরঘাট, খেলার মাঠ। ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলো এখন বসেছে পথে। অবশিষ্ট আছে শুধু সর্বহারা মানুষের আহাজারি।
ভোলা জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ইলিশা ফেরিঘাট। এ ঘাট থেকে ট্রলারে ওপারে গেলেই রামদাসপুর। ভর দুপুরে জোয়ারের পানিতে দ্বীপের আশপাশ সবে ডুবতে শুরু করেছে। জেলেদের কেউ কেউ ছোট নৌকায় নদীতে মাছ ধরছে। কেউবা মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আবার কেউ কিছুক্ষণ আগে নদী থেকে এসে অলস দুপুরে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কিছু মানুষ ভাঙা তীরে ভেঙে পড়া গাছ কাটার কাজে ব্যস্ত। অনেকে আবার কর্মহীন। বয়সী কিছু কর্মক্ষম ব্যক্তি রাস্তার ধারে বসে জীবনের-না -মেলা-হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন।
ভাঙনের তীরে দাঁড়িয়ে নদীর মাঝে নিজের বাড়িটি দেখানোর চেষ্টায় বৃদ্ধ রতন সরদার বলেন, বাড়ি ছিল নদীর মাঝে। ছয়বার স্থান বদল করে এখন কোনোমতে এ চরে ঠাই মিলেছে। জানালেন, অনেক সহায় সম্পদ ছিল তার। গাছপালা ছিল প্রচুর পরিমাণে। ছিল ফসলি জমি। এখন একেবারেই নিঃস্ব। নিজে কাজ করতে পারেন না। ছেলেদের রোজগারে বেঁচে আছেন।
রামদাসপুরে হাঁটার পথ ধরে চলতে চলতে ঘড়বাড়ির চালা, বেড়া, খুঁটি ছাড়াও বিভিন্ন আসবাবপত্র চোখে পড়ে। নদী ভাঙনে বাড়ি হারানোর পর মানুষগুলো এসব মালামাল এনে স্তুপ করে রেখেছে। ভাঙনের কিনারে একদল মানুষ সারাক্ষণই এ কাজটি করছে। কারণ নদী ভেঙেই চলেছে। সঙ্গে ভাঙছে বাড়িও।
আবারও ঘরছাড়া। এ মানুষগুলোকে দ্বীপের কোনো খালি জায়গা বের করে আবারও একটি থাকার ঝুপড়ি বানাতে হচ্ছে। বহতা নদীর মতো মেঘনা তীরের রামদাসপুরের জীবন এভাবেই বাঁক বদলাতে থাকে।
এখন রামদাসপুরে পুরোটাই হাঁটাপথ। রিক্সা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, টেম্পো সবই ছিল এখানে। কিন্তু এখন নেই। দ্বীপের মানুষ হেঁটেই যাতায়াত করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। নদী ভাঙনের কবলে অল্প কিছু রাস্তা আছে। এগুলোকে ঠিক রাস্তা বললে ভুল হবে। বলা যায় হাঁটার পথ।
ইট বিছানো রাস্তার ইটগুলো খসে খসে পড়ছে। ভেঙে ভেঙে রাস্তা উঁচু-নিচু হয়ে গেছে। এ অবশিষ্টটুকু কবে নিঃশেষ হয়ে যাবে, এটাই এখন দেখার অপেক্ষা। তখন রামদাসপুরের পথ দিয়ে আর হাঁটার সুযোগ থাকবে না। সেদিন হয়তো আর খুব বেশি দূরে নয়।
দ্বীপের বয়সী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথায় জানা গেল, ৩০০ বছরের পুরোনো এ দ্বীপের এখন এক তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট আছে। একই হারে লোকসংখ্যা, ফসলি জমি সবই কমে গেছে।
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারটি হাটবাজার, চারটি মসজিদ, একটি বালিকা বিদ্যালয়, একটি সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র, ১৫ কিলোমিটার রাস্তা, সাত হাজার বাড়ি, দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাগদা চিংড়ি পল্লী, একশ বছরের পুরোনো বটগাছ মেঘনা গর্ভে হারিয়ে গেছে। এলাকার বহু মানুষ নোয়াখালী, বরিশাল, চরফ্যাশন, ভোলা সদর, চট্টগ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছে।
দ্বীপ ঘুরলে মনে হয়, দুর্যোগের পর মানুষগুলো আবার নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে। গাছকাটা, মাটিকাটা, ঘর বানানো, রান্নার চুলা ঠিকঠাক করা এখন দ্বীপবাসীর প্রায় প্রতিদিনের কাজ। বেশ কবছর ধরে এগুলো দ্বীপের নিত্যদিনের কাজ।
রাতদিন দ্বীপের সবার চোখ থাকে পূর্বে মেঘনা তীরের দিকে। কখন ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে, তীরের মাটিতে কখন বড় একটা ফাটল ধরে অনেকখানি ভেঙে যায়, এ চিন্তাই দ্বীপবাসীকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে ফেরে।
সূত্র বলছে, ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের দু নম্বর ওয়ার্ড রামদাসপুরের আয়তন একেবারেই ছোট হয়ে এসেছে। এক সময় চারিদিকে ২২ কিলোমিটার পরিধি থাকলের এখন আছে মাত্র ৫ কিলোমিটার। দুইটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।
এদের একটি বিদ্যালয়ের ভবন ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এখন রাস্তার পাশে ঝুপড়ি বানিয়ে ক্লাস চলে। এপারেই ছিল ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, এখন সেটি পরিত্যক্ত। কার্যক্রম চলে ওপারে। একমাত্র ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রটিও এখানেই আছে। এর অবস্থাও জরাজীর্ণ। ফাটল ধরেছে ভবনে।
কেন্দ্রের এফডব্লিউভি লুৎফুন নেছা খানম বাংলানিউজকে বলেন, এখানে সমস্যা অন্তহীন। স্বাভাবিক সন্তান প্রসব এখানে হয়। কিন্তু জটিল রোগী ভোলা সদরে পাঠিয়ে দিই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবন জরাজীর্ণ। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। রোগী দেখা কিংবা আবাসিকভাবে বসবাসের উপযোগী নেই। অবিলম্বে এটি স্থানান্তর প্রয়োজন।
দ্বীপের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত শুধুই মানুষের আকুল আহাজারি। এক সময়ের সহায়-সম্পদ আর বাড়িঘরের দৃশ্য তারা আর মনে করতে পারেন না। সেসব দিনের স্মৃতি তাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। মেঘনার ভাঙনের তীরে এসে কথা হলো মফিজা খাতুন, জায়েদ সরকার, নাগর চৌকিদার ছাড়াও কজনের সঙ্গে।
রাস্তার মাথায় ভাঙনের কিনারে কজন নামাজ পড়ছেন। একেবারেই নদীর কিনারে জায়গাটি। দুদিন আগে মসজিদের চালা বেড়া, খুঁটি ছাড়াও সব অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু হোগল পাতার কয়েকটি হোগলা বিছানো আছে। এরই ওপরই এখন নামাজ পড়া হয়। দুদিন পর হয়তো এ জায়গাও বিলীন হয়ে যাবে।
মধ্য রামদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এখানকার শিক্ষার্থীদের মাত্র ৬০ ভাগ স্কুলে আসে। বাকিরা বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরে। এখানকার মানুষ নিঃস্ব হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। জীবিকার প্রয়োজনে তাই ছেলেমেয়েদের কাজে যেতেই হয়।
তিনি জানান, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবক্ষেত্রেই এখানে সংকটপূর্ণ। ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে এককালের স্বচ্ছল কৃষকেরা। এদের এখন দিন আনে দিন খাওয়া অবস্থা। দুর্যোগ এলে এ দ্বীপের একমাত্র আশ্রয়ের স্থান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। দ্বীপে কোনো ফসলি জমি নেই। মাত্র ২০-২২ একর জমি আছে। তাও ব্যবহার হয় হাঁটাচলায়।
এ এলাকাটি ভোলা-১ আসনের আওতাভুক্ত। দ্বীপের বাসিন্দারা বাংলানিউজকে সরেজমিনে পেয়ে জানালেন, নির্বাচনে ভোট দিলেও জনপ্রতিনিধিরা এসব দ্বীপের মানুষের কোনো খোঁজ রাখেন না। নির্বাচনের পর এলাকার লোকজন এমপি কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে খুব একটা দেখেননি বলেও সুস্পষ্ট অভিযোগ করেন।
এলাকাবাসী পাওয়া তো দূরের কথা। রামদাসপুরের তথ্য জানতে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম মিঠু চৌধুরীকে এলাকা কিংবা জেলা সদর কোথাও খুঁজে পায়নি বাংলানিউজের সরেজমিন দল।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS